Monday, July 9, 2012

ফসলের ক্ষতির আশঙ্কা ব্যাপক




নদীতে অস্বাভাবিক হারে পানি বৃদ্ধি, উজানের ঢল, বন্যাসহ বৈরী প্রকৃতির কারণে ফসলের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন চাষী ও কৃষি কর্মকর্তারা। দেশের বিভিন্ন স্থানে তলিয়ে গেছে আউশ ধান, পাট ও আমনের বীজতলা। এছাড়াও অন্যান্য ফসল ডুবে গেছে। কোনো কোনো স্থানে ফসলে পচন ধরেছে। ফলে চলতি আউশ মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি ফসল উত্পাদনে ধস নামার আশঙ্কা করছেন কৃষি কর্মকর্তারা। উত্পাদিত ফসল হারিয়ে দিশেহারা গরিব চাষীরা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সরেজমিন উইংয়ের পর্যালোচনা রিপোর্টে ফসলের ক্ষতি ও কৃষকের আর্থিক লোকসানের বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্য মতে মধ্য আগস্ট থেকে দ্বিতীয় দফায় অতি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে দেশের বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পায়। গত দুই-তিন দিনে নতুন করে ১২টি জেলার ফসল তলিয়ে গেছে। নেত্রকোনা, গাইবান্ধা, নীলফামারী, নড়াইল, ঝালকাঠি, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, শেরপুর, বাগেরহাট, টাঙ্গাইল, নওগাঁ ও জামালপুরে তলিয়ে গেছে ৬০ হাজার হেক্টর জমির ফসল। এছাড়াও অন্যান্য জেলাতেও ফসলের জমিতে পানি প্রবেশ করেছে। নিমজ্জিত ফসলের মধ্যে বেশি ক্ষতি হয়েছে সবজির, বিশেষ করে কাঁচা মরিচের। এছাড়াও অনেক স্থানে ভেসে গেছে জাগ দেয়া পাট ও পুকুরসহ বিভিন্ন জলাশয়ের মাছ। আউশ ও আমন ধানেরও বেশ ক্ষতি হয়েছে। টানা ৮-১০ দিন পানি জমে থাকায় অনেক স্থানে নষ্ট হয়ে গেছে রোপা আমনের বীজতলা। এতে বিঘ্নিত হবে আমন চাষ। এবছর রোপা আমনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫২ লাখ ১৯ হাজার হেক্টর জমিতে। গতকাল পর্যন্ত ৩৫ লাখ ৮০ হাজার ৯৪৯ হেক্টর জমিতে আমন রোপণ সম্পন্ন হয়েছে। নজরুল ইসলাম বলেন, আগামী ৩০ আগস্টের মধ্যে উচ্চ ফলনশীল আমন রোপণ চলবে। আর দেশীয় বা অন্যান্য জাতের আমন রোপণ চলবে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। তিনি আশা করেন, বর্ষাকালীন এই আবহাওয়া বেশি দিন স্থায়ী হয় না। পানি নেমে গেলেই আবার পুরোদমে আমন রোপণ শুরু হবে। সে ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সহজ হবে।
এর আগে গত ২ আগস্ট থেকে বৃষ্টিপাত শুরু হলে কৃষকরা আমন রোপণ শুরু করে। তবে ৬ আগস্ট থেকে শুরু হয় ভারী বর্ষণ। ৭ থেকে ৯ আগস্ট তিন দিন ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হয়েছে দেশব্যাপী। ১০ আগস্ট রাত পর্যন্ত ভারী বর্ষণ অব্যাহত ছিল। আবহাওয়া অফিসের তথ্য মতে এ সময় প্রতিদিন গড়ে ১০০ মিলিমিটারের ওপরে বৃষ্টিপাত হয়েছে। দেশের অনেক এলাকায় রোপা আমনের বীজতলা ও রোপিত আমন ক্ষেত তলিয়ে যায়। কৃষি বিভাগের তথ্য মতে সে সময়ের টানা বর্ষণে ১৯টি জেলায় প্রায় সাড়ে ৭ লাখ হেক্টরের দণ্ডায়মান ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জলমগ্ন হয় প্রায় ৭৫ হাজার হেক্টর জমি। তবে দ্রুত পানি সবজি বাদে ধান ফসলের উপকারই হয়েছিল।
জানা গেছে, সম্প্রতি বন্যা ও নদীতে অস্বাভাবিক হারে পানি বৃদ্ধিসহ বৈরী প্রকৃতিতে খুলনা, বাগেরহাট, ভোলা, পটুয়াখালীসহ উপকূলীয় এলাকায় ফসল ডুবে গেছে। আউশ পাকার আগেই ধান নষ্ট হয়ে গেছে। বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় আমন চাষের সময় বীজ সঙ্কটের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। শাক-সবজি ক্ষেতে পচন ধরেছে। কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলায় আকস্মিক বন্যায় তলিয়ে গেছে ১ হাজার হেক্টর জমির ফসল। আউশ ধান ও পাট তলিয়ে গেছে। প্রতিদিন নতুন নতুন ফসলি জমি জলমগ্ন হচ্ছে। উপজেলার রামকৃষ্ণপুর, চিলমারী, ফিলিপনগর ও মরিচা ইউনিয়নের চরাঞ্চলের অধিকাংশ আবাদি জমি পানির তলায়। আকস্মিক বন্যায় উঠতি ফসল হারিয়ে ওই অঞ্চলের হাজার হাজার কৃষক এখন প্রায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে। ধান ও পাট কেটে ঘরে তোলার আগেই বন্যা হানা দেয়ায় তলিয়ে গেছে কৃষকদের সে সব ফসলের ক্ষেত।
অকাল বন্যায় সিলেট অঞ্চলের ২০ হাজার হেক্টর আউশ-আমন জমি ও সবজি ক্ষেত তলিয়ে গেছে। ফলে উত্পাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ অঞ্চলের চার জেলায় ৬ লাখ ৭১ হাজার ৯শ’ মেট্রিক টন ধান উত্পাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সিলেট বিভাগের চার জেলার মধ্যে নিমজ্জিত জমির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায়। তবে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হলে ওই দুই জেলায় আবাদ হওয়া জমিও তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সিলেটের চার জেলায় ৯৭ হাজার ২৬ হেক্টর জমিতে আউশ ও ৩ লাখ ৫৫ হাজার ৫০৪ হেক্টর জমিতে বোনা আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এ জমি থেকে ৬ লাখ ৭১ হাজার ৯শ’ টন ধান উত্পাদন হওয়ার কথা। কিন্তু গত কয়েকদিনের বন্যা সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়েছে। বিশেষ করে সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় আকস্মিক ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়ায় কৃষকরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। ফসলি জমিসহ মাঠ-ঘাট তলিয়ে যাওয়ায় বন্যাকবলিত কৃষকরা গবাদিপশুর খাদ্য সংস্থান নিয়েও দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। সরকারি হিসাব অনুযায়ী বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়া ফসলি জমির মধ্যে সবচেয় বেশি জমি নিমজ্জিত হয়েছে সিলেট জেলায়। এ জেলায় ১০ হাজার ৯৪০ হেক্টর আউশ, ৫৪৫ হেক্টর বোনা আমন ও ১ হাজার ৩৯৫ হেক্টর সবজি জমির বীজতলা তলিয়ে গেছে। সুনামগঞ্জের ১০টি উপজেলার মধ্যে ৪টি উপজেলার হিসাব পাওয়া গেছে। এই চার উপজেলায় আবাদকৃত ৫ হাজার ৪৬৭ হেক্টর জমির মধ্যে আউশ ১ হাজার ৩১২, আমন ১৩০ ও ৩৩০ হেক্টর সবজি ক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে। এই দুই জেলায় সরকারি হিসাব মতে, মাত্র ১৪ হাজার ৬৫২ হেক্টর জমি তলিয়ে গেলেও মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের কোনো হিসাব নেই।
অবিরাম বর্ষণে গোপালগঞ্জের বিভিন্ন গ্রামের ফসল পানিতে ডুবে গেছে। কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, ভারী বর্ষণে কোটালীপাড়া থানার কান্দি, রাধাগঞ্জ, সাদুল্লাপুর ও কলাবাড়ি ইউনিয়নের কান্দি, মাচারতারা, তালপুকুরিয়া, হিজলবাড়ি, উত্তর নৈয়ারবাড়ি, পূর্ব নৈয়ারবাড়ি, কলাবাড়ি, চরপুকুরিয়া, গোপালপুর, কলাভিটা, কালীগঞ্জ, তেঁতুলবাড়িসহ প্রায় ২৫টি গ্রামের আবাদি জমিতে রোপণকৃত কুশি, উস্তে, ঢেঁড়স, ডাটা ও লাউসহ বিভিন্ন শাক-সবজির ক্ষেত পানিতে ডুবে গেছে। একইসঙ্গে ডুবে গেছে আমন ধানের জমি। এছাড়াও টুঙ্গিপাড়ার গোপালপুর, মিত্রডাংগা, যোয়ারিয়া, পাথরঘাটা ও বন্যাবাড়িসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের ফসলি জমি পনিতে ডুবে গেছে। এছাড়া মুকসুদপুর, কাশিয়ানি ও সদর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের নিচু এলাকার ফসল তলিয়ে গেছে।
ভোলায় লোনা পানিতে প্রায় পাঁচ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলার বেশিরভাগ জমির বোরো ধান চিটা হয়ে গেছে। অন্যান্য ফসলও পচে নষ্ট হয়ে গেছে।
জেলা কৃষি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জোয়ারে লবণাক্ত পানি প্রবাহিত জেলার বিভিন্ন উপজেলার ১৭টি ইউনিয়নের প্রায় আট হাজার হেক্টর জমি জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়। জোয়ারের ওই পানিতে উচ্চমাত্রায় লবণ ছিল। পরে কিছু জমি থেকে পানি নেমে গেলেও লবণের প্রভাবে ফসল ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়। জমির বোরো ধান চিটা হয়ে গেছে। এছাড়া ডাল, সয়াবিনসহ অন্যান্য ফসলও নষ্ট হয়ে গেছে।

No comments:

Post a Comment