খেজুর
আরব দেশের মেসোপটেমিয়াই খেজুরের আদি জন্মস্থান। উন্নত জাতের খেজুর বলতে শাঁস বেশী ও বীজ ছোট এমন খেজুরকে বোঝানো হয়। সে হিসাবে সৌদি আরব ও এর আশপাশের দেশগুলোতে যে খেজুর হয় তা উন্নত এবং বাংলাদেশে যে খেজুর হয় তা অনুন্নত জাতের। ইরাক, ইরান বা আরব দেশে যে উন্নত খেজুর উৎপন্ন হয় তার প্রজাতির নাম Phoenix dactylifera। এ গাছ লম্বায় ২৫ মিটার বা তার চেয়েও বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে যে খেজুরের চাষ হয় তার নাম Phoenix sylvestris। এ গাছের উচ্চতা ১০/১৫ মিটার হয়ে থাকে। বাংলাদেশের জাতটিকে বুনো জাত বলা হয়।
পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি খেজুরের চাষ ইরাকে হলেও বর্তমানে ইরান, ভূমধ্যসাগরের উপকূলবর্তী আরব দেশগুলো, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ যেমন আলজেরিয়া, লিবিয়া, সুদান, তিউনিসিয়া, মরক্কো, দক্ষিণ আফ্রিকা দক্ষিণ আমেরিকা, মধ্য অষ্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান এসব দেশে খেজুর চাষ হয়।খেজুর পাতার কুটির মরুর দেশে বিখ্যাত।
পত্রবৃন্তে আবৃত খেজুরের কাণ্ডটি সরল,গোলাকৃতি ও ধূসর বর্ণের । মাথায় মুকুটের মতো ছড়ানো পাতাগুলো উর্ধ্বমুখী ও ছুরির ফলার মতো তীক্ষ্ণ। খেজুরের স্ত্রী ও পুরুষ ফুল ভিন্ন গাছে থাকে (ভিন্নবাসী)। পুং পুষ্পমঞ্জরী খাটো, ফুল সাদা কিন্তু স্ত্রী পুষ্পমঞ্জরী লম্বা ও ফুলের রং হালকা সবুজ। ফল অজস্র ও উজ্জ্বল। বাংলাদেশে খেজুরের কোনো উন্নত জাত নেই এবং উন্নত জাত বের করার ওপর কোনো কাজও হয়নি। খেজুরের প্রসিদ্ধ জাতগুলোর মধ্যে হাইয়ানী (মিসরের), সাইদী (লিবিয়ার), মেদঝল (মরক্কোর) এবং ভেগলেনটুর (তিউনিসিয়ার) উল্লেখযোগ্য।
খেজুরের পুরুষ ও স্ত্রী ফুল আলাদা আলাদা গাছে জন্মে। পুরুষ ফুলগুলো মোচার মত দেখতে, ঘিয়ে রঙ-এর, পরিপক্ক ফুলের মোচা ঝাকুনি দিলে ধুলার মত পুংরেণু বের হয়।
স্ত্রী ফুল দেখতে ভিন্ন রকম। একটা মজ্ঞরীতে অনেক স্ত্রী ফুল ফোটে, যা থেকে একটি কাঁদি তৈরী হয়।
খেজুর গাছের মাথা অসংখ্য কাঁটার সমন্বয়ে একটি ঝোপের মত কারণ খেজুর গাছের পাতার গোড়ার দিকের পত্রকগুলো কাঁটায় রূপান্তরিত। পাতা সাধারনত ৩ মিটার লম্বা হয় এবং সাধারনত নীচের দিকে বাঁকানো। খেজুর গাছ সারা বছরই একই রকম দেখায়।
পাকা ফল দেখতে পার্পেল-লাল রঙের, সুমিষ্ট, খাওয়া যায়। পাখিদের ও প্রিয় এটি।বিদ্রোহী কবি নজরুলের অনেক গান ও কবিতায় খেজুরের উল্লেখ আছে। ছড়াকার সুকুমার রায় খেজুরের গুড় নিয়ে লিখেছেন ছড়া_ _
দাদা গো! দেখছি ভেবে অনেক দূর-
এই দুনিয়ার সকল ভাল,
আসল ভাল নকল ভাল,
সস্তা ভাল দামীও ভাল
তুমিও ভাল আমিও ভাল,
……………………….
……………………….
……………………….
গিটকিরি গান শুনতে ভাল,
শিমুল তুলা ধুনতে ভাল,
ঠান্ডা জলে নাইতে ভাল,
কিন্তু সবার চাইতে ভাল,
পাউরুটি আর ঝোলা গুড়।
শীত কালে খেজুরের রস সবারই রসনা তৃপ্ত করে। আর খেজুর গাছের মাথার কচি অংশ তো দারুন লাগে খেতে। খেজুর গাছ ছয় সাত বছর বয়স থেকে রস দেওয়া শুরু করে। পঁচিশ থেকে ত্রিশ বছর পর্যন্ত রস দেয়। গাছ পুরনো হয়ে গেলে রস কমে যায়। পুরনো গাছের রস খুব মিষ্টি হয়। মাঝ বয়সী গাছ থেকে সবচেয়ে বেশি রস পাওয়া যায়। বেশি রস সংগ্রহ করা গাছের জন্য ক্ষতিকর। রস সংগ্রহের জন্য কার্তিক মাসে খেজুর গাছ কাটা শুরু হয়। কার্তিক মাস থেকেই রস পাওয়া যায়। রসের ধারা চলতে থাকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত। শীতের সঙ্গে রস ঝরার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। শীত যত বেশি পড়বে তত বেশি রস ঝরবে। রসের স্বাদও তত মিষ্টি হবে। অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ মাস হলো রসের ভর মৌসুম। একবার গাছ কাটার পর দুই তিন দিন রস পাওয়া যায়। প্রথম দিনের রসকে বলে জিরান কাট। জিরান কাট রস খুবই সুস্বাদু। প্রথম দিনের রস থেকে ভালো পাটালি গুড় তৈরি হয়। দ্বিতীয় দিনের রসকে বলে দোকাট। তৃতীয় দিনের রসকে বলে তেকাট। রসের জন্য গাছ একবার কাটার পর পাঁচ ছয় দিন পর আবার কাটা হয়। গাছের কাটা অংশ শুকানোর জন্য এসময় দেওয়া হয়। কাটা অংশ শুকানোর সুবিধার জন্যই সাধারণত পূর্ব ও পশ্চিম দিকে গাছ কাটা হয়। যাতে সূর্যের আলো সরাসরি কাটা অংশে পড়ে। রস পেতে হলে খেজুর গাছ বিশেষ কায়দায় কাটতে হয়। যারা গাছ কাটে তাদের বলা হয় গাছি। গাছিদের গাছ কাটার জন্য কয়েকটি উপকরণ দরকার হয়। যেমন-দা, দা রাখার জন্য একটি ঝাঁপি, দড়ি এবং এক টুকরো চামড়া বা পুরনো বস্তা। গাছি যে ঝাঁপি ব্যবহার করে তা বাঁশ দিয়ে তৈরি। গাছে উঠার সময় গাছি এই ঝাঁপিতে দা রাখে। কোমরে বেঁধে নেয় চামড়া বা বস্তা। গাছ কাটার সময় শরীরের ভারসাম্য রক্ষার জন্য গাছি কোমর বরাবর গাছের সঙ্গে দড়ি বেঁধে নেয়। দড়িটা বিশেষভাবে তৈরি করা হয়। এই দড়ির দুই মাথায় বিশেষ কায়দায় গিট দেওয়া থাকে। গাছে উঠার সময় গাছি অতি সহজে মুহূর্তের মধ্যে গিঁট দুটি জুড়ে দিয়ে নিজের জন্য গাছে উঠার নিরাপদ ব্যবস্থা করে নেয়।গাছ কাটার জন্য গাছের মাথার এক দিকের শাখা কেটে চেঁছে পরিষ্কার করা হয়। কাটা অংশের নিচের দিকে দুটি খাঁজ কাটা হয়। খাঁজ থেকে কয়েক ইঞ্চি নিচে একটি সরু পথ বের করা হয়। এই সরু পথের নিচে বাঁশের তৈরি নলী বসানো হয়। এই নলী বেয়ে হাড়িতে রস পড়ে। নলীর পাশে বাঁশের তৈরি খিল বসানো হয়। এই খিলে মাটির হাড়ি টাঙিয়ে রাখা হয়। এই হাড়িতে রস জমা হয়।গাছ থেকে রস সংগ্রহের জন্য মাটির হাড়ি ব্যবহার করা হয়। এই হাড়িকে বলে ভাঁড়। কোথাও বলে ঠিলা। ভাঁড় দেখতে অনেকটা ছোট আকৃতির কলসের মতো। মাঝারি আকৃতির দশ থেকে পনেরো ভাঁড় রস জ্বাল দিলে এক ভাঁড় গুড় হয়। এই এক ভাঁড় গুড়ের ওজন হয় ছয় থেকে আট কেজির মতো।খেজুরের রস হতে তৈরি গুড়। মিষ্টি জাতীয় খাবার। বাংলাদেশে বেশ প্রসিদ্ধ। শীত কালে তৈরি হয় এবং সারা বছর ই পাওয়া যায়। প্রচুর খনিজ ও পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ।
গুড় তৈরির জন্য রস জ্বাল দেওয়া হয় মাটির জালায় বা টিনের তাপালে। খুব সকালে রস নামিয়ে এনেই জ্বালানো হয়। জ্বাল দিতে দিতে এক সময় রস ঘন হয়ে গুড় হয়ে যায়। এ গুড়ের কিছু অংশ তাপালের এক পাশে নিয়ে বিশেষভাবে তৈরি একটি খেজুর ডাল দিয়ে ঘষতে হয়। ঘষতে ঘষতে এই অংশটুকু শক্ত হয়ে যায়। এই শক্ত অংশকে বীজ বলে। বীজের সঙ্গে তাপালের বাকি গুড় মিশিয়ে দেওয়া হয়। স্বল্পক্ষণের মধ্যে গুড় জমাট বাঁধতে শুরু করে। তখন এই গুড় মাটির হাঁড়ি বা বিভিন্ন আকৃতির পাত্রে রাখা হয়। গুড় জমাট বেঁধে পাত্রের আকৃতি ধারণ করে।
এই খেজুর গুড় যারা বানায়, তাদের ঐতিহ্যগত পরিচয় তারা গুড়-শিল্পী বা শিউলি। এই শিউলিরা আদতে খেতমজুর। বর্ষার দিনে অধিকাংশ অঞ্চলে চাষাবাদের পর ভূমিহীন খেতমজুরদের কোনও কাজ থাকে না। অনাহার-অর্ধাহারে তাদের দিন কাটাতে হয়। সেই সময় শিউলিরা দাদন নেয় মহাজনের কাছ থেকে। বিনিময়ে মহাজনের নির্ধারিত দামে অনেক সময় তাদের কাছেই গুড় বিক্রি করতে বাধ্য হয়।
এই খেজুর গুড় যারা বানায়, তাদের ঐতিহ্যগত পরিচয় তারা গুড়-শিল্পী বা শিউলি। এই শিউলিরা আদতে খেতমজুর। বর্ষার দিনে অধিকাংশ অঞ্চলে চাষাবাদের পর ভূমিহীন খেতমজুরদের কোনও কাজ থাকে না। অনাহার-অর্ধাহারে তাদের দিন কাটাতে হয়। সেই সময় শিউলিরা দাদন নেয় মহাজনের কাছ থেকে। বিনিময়ে মহাজনের নির্ধারিত দামে অনেক সময় তাদের কাছেই গুড় বিক্রি করতে বাধ্য হয়।
খেজুর গুড়
সারা বাংলাদেশেই খেজুর গাছ আছে। তবে বৃহত্তর খুলনা, ফরিদপুর, বরিশাল এবং যশোর জেলায় প্রচুর খেজুর গাছ জন্মে। এর মধ্যে যশোরের খেজুর রস আর খেজুর গুড়ই বিশেষভাবে খ্যাত। এক সময় যশোরের খেজুর থেকে চিনিও তৈরি হতো। যশোরের খেজুর গুড় থেকে এখনো স্বল্প পরিমাণে চিনি তৈরি হয়। কথায় বলে, যশোরের যশ খেজুরের রস।
একটি পূর্ণবয়স্ক তালগাছ হতে দৈনিক ১০ কেজি রস হিসেবে ফাল্গুন থেকে জ্যৈষ্ঠ মাস মেয়াদে ১২০ দিনের মৌসুমে মোট আহরিত রস ১২০০ কেজি। ১০% চিনি হিসেবে প্রতি গাছ হতে চিনি পাওয়া যাবে ১২০ কেজি। ৫% হিসেবে প্রতি গাছ হতে ঝোলা গুড় পাওয়া যাবে ৬০ কেজি। একটি খেজুর গাছ হতে মাসে ৪০ কেজি রস হিসেবে অগ্রহায়ণ থেকে ফাল্গুন মাস মেয়াদে ১২০ দিনের মৌসুমে মোট আহরিত রস ১৬০ কেজি। ১০% চিনি হিসেবে প্রতি গাছ হতে চিনি পাওয়া যাবে ১৬ কেজি। ৫% হিসেবে প্রতি গাছ হতে ঝোলা গুড় পাওয়া যাবে ৮ কেজি। এ হিসেব বেশি মনে হলে ধরে নেয়া যাক প্রতি খেজুর বা তাল গাছ হতে বছরে এক মৌসুমে গড়ে ৪০ কেজি গুড়/চিনি উৎপাদন করা যাবে। এতে ১২ লাখ টন গুড় ও চিনি উৎপাদন করতে মোট গাছ প্রয়োজন হবে প্রায় তিন কোটি।
খেজুর গাছ শুধু রস দিয়েই ক্ষান্ত হয় না। খেজুর পাতা দিয়ে পাটি তৈরি হয়। খেজুর পাতা দিয়ে এক ধরনের সাহেবী টুপিও তৈরি হয়। খেজুর পাতা, ডাল এবং গাছ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। গ্রামে মোরুব্বা তৈরিতেও খেজুর কাটার ব্যবহার আছে।
ভেষজ গুন: শুকনো খেজুর থেকে বীজটা বার করে নিয়ে দুধে ভাল করে ফোটান৷ খেজুর দুধের মধ্যে মিশে যাওয়ার পর ঐ দুধটা ঠান্ডা করে শিশুদের খাওয়ান৷ এতে শিশুদের শক্তি বাড়বে৷
ফলের পুষ্টিমান:
একটি শুকনো খেজুরে প্রায় ৭৫-৮০% শর্করা, ২% আমিষ এবং প্রায় ২.৫% স্নেহজাতীয় পদার্থ থাকে। ১০০ গ্রাম শাঁসে ২০ ভাগ পানি, ৬০-৬৫ ভাগ শর্করা, ২ ভাগ আমিষ এবং খুব সামান্য কপার, ম্যাগনেসিয়াম, সালফার, ভিটামিন এ, বি-১, বি-২ ও খনিজ লবণ থাকে।
একটি পূর্ণবয়স্ক তালগাছ হতে দৈনিক ১০ কেজি রস হিসেবে ফাল্গুন থেকে জ্যৈষ্ঠ মাস মেয়াদে ১২০ দিনের মৌসুমে মোট আহরিত রস ১২০০ কেজি। ১০% চিনি হিসেবে প্রতি গাছ হতে চিনি পাওয়া যাবে ১২০ কেজি। ৫% হিসেবে প্রতি গাছ হতে ঝোলা গুড় পাওয়া যাবে ৬০ কেজি। একটি খেজুর গাছ হতে মাসে ৪০ কেজি রস হিসেবে অগ্রহায়ণ থেকে ফাল্গুন মাস মেয়াদে ১২০ দিনের মৌসুমে মোট আহরিত রস ১৬০ কেজি। ১০% চিনি হিসেবে প্রতি গাছ হতে চিনি পাওয়া যাবে ১৬ কেজি। ৫% হিসেবে প্রতি গাছ হতে ঝোলা গুড় পাওয়া যাবে ৮ কেজি। এ হিসেব বেশি মনে হলে ধরে নেয়া যাক প্রতি খেজুর বা তাল গাছ হতে বছরে এক মৌসুমে গড়ে ৪০ কেজি গুড়/চিনি উৎপাদন করা যাবে। এতে ১২ লাখ টন গুড় ও চিনি উৎপাদন করতে মোট গাছ প্রয়োজন হবে প্রায় তিন কোটি।
খেজুর গাছ শুধু রস দিয়েই ক্ষান্ত হয় না। খেজুর পাতা দিয়ে পাটি তৈরি হয়। খেজুর পাতা দিয়ে এক ধরনের সাহেবী টুপিও তৈরি হয়। খেজুর পাতা, ডাল এবং গাছ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। গ্রামে মোরুব্বা তৈরিতেও খেজুর কাটার ব্যবহার আছে।
ভেষজ গুন: শুকনো খেজুর থেকে বীজটা বার করে নিয়ে দুধে ভাল করে ফোটান৷ খেজুর দুধের মধ্যে মিশে যাওয়ার পর ঐ দুধটা ঠান্ডা করে শিশুদের খাওয়ান৷ এতে শিশুদের শক্তি বাড়বে৷
ফলের পুষ্টিমান:
একটি শুকনো খেজুরে প্রায় ৭৫-৮০% শর্করা, ২% আমিষ এবং প্রায় ২.৫% স্নেহজাতীয় পদার্থ থাকে। ১০০ গ্রাম শাঁসে ২০ ভাগ পানি, ৬০-৬৫ ভাগ শর্করা, ২ ভাগ আমিষ এবং খুব সামান্য কপার, ম্যাগনেসিয়াম, সালফার, ভিটামিন এ, বি-১, বি-২ ও খনিজ লবণ থাকে।
No comments:
Post a Comment